মোঃ ইকরাম হাছান
এ শহরে গাড়ির সংখ্যার হিসেবে যথেষ্ট রাস্তা নেই। এ কারণে যানজট এ নগরীর দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। সংস্থাটির তালিকায় শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের মধ্যে আরো আছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা এবং কুমিল্লা। অথচ যানজট নিরসন করে শহরকে গতিময় করতে ২০১২ সালের পর থেকে গত এক দশকে সড়ক, সেতু, মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ সময়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ এবং মেট্রোরেলের একটি রুটের একাংশ ছাড়াও শহরের মধ্যে ছোট-বড় অন্তত সাতটি নতুন ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু তাতে কোনো কোনো জায়গায় কমে এলেও শহরের সার্বিক যানজট অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ফ্লাইওভারের ওপরেও দীর্ঘ সময়ের যানজট দেখা যাচ্ছে প্রায়ই।
প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম : একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এ শহরে। অন্যদিকে ট্রাফিক বিভাগের হিসাবমতে, ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে। এ ছাড়া ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট।
মার্কিন সংস্থার মতামত : পৃথিবীর ১৫২টি দেশের ২০০-এর বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে ধীরগতির ২০ শহরের মধ্যে ঢাকার পরেই আছে নাইজেরিয়ার দুটি শহর। যানবাহনের চাপ কম থাকলেও বাংলাদেশের চারটি শহর ধীরগতির শহর হিসেবে ওই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।
ঢাকা ধীরগতি হওয়ার কারণ : সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় সোয়া ১ লাখ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে যোগাযোগের নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে। কিন্তু তারপরও শহরের যানজট পরিস্থিতির অবনতিই ঘটে চলেছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার; যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। এরপর ২০২৫ সাল নাগাদ এটি ৪ কিলোমিটারের নিচে চলে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমেছে ঘণ্টায় অন্তত ১৬ কিলোমিটার। অথচ একের পর এক ফ্লাইওভার আর নিত্য নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শহরজুড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে প্রায় আট থেকে ১০ বছর।
রাইড শেয়ারিংকে জনপ্রিয় করেছে : অধ্যাপক সামছুল হক বলছেন, ‘যানজট নিরসনের জন্য টেকসই পদ্ধতির কথা কখনো চিন্তা করা হয়নি। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সটাই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং সমাধানের জন্য যা করা হচ্ছে, তা যানবাহনের সংখ্যার তোড়ে ভেসে যাচ্ছে।’ এরপর ২০১৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং পরিসেবা শুরু হয়। মোটরসাইকেলের অন্তর্ভুক্তি রাইড শেয়ারিংকে আরো জনপ্রিয় করেছে। এরপর গত ৬ বছরে ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় ৮ লাখ। বিআরটিএ’র হিসেবে, ২০১০ সালে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩১৩। আর ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৭ হাজার ৪৮৪টিতে। অর্থাৎ সব ধরনের যানবাহনের সংখ্যাই বেড়েছে, কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় গণপরিবহনের সঠিক বিন্যাস করা হয়নি। আবার নিম্নমানের বাস-মিনিবাস মানুষের উপকারে না এসে বরং যান চলাচলে শৃঙ্খলাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে বলেও মনে করেন অনেকে।যান চলাচলে কিছুটা স্বস্তির বাতাস : তবে এক সময় ঢাকার দীর্ঘ ফ্লাইওভার হিসেবে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছিল প্রাইভেট পাবলিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এটি নির্মাণে তখন ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো। ফ্লাইওভারটি চালুর পর ওই এলাকায় যান চলাচলে কিছুটা স্বস্তির বাতাস এসেছিল। কিন্তু পরে ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের অনেক জায়গায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়াসহ নানা কারণে এখন ফ্লাইওভারটির ওপরেই দীর্ঘ যানজট নিয়মিত ঘটনা। বিশেষ করে, পদ্মা সেতু চালুর পর যানবাহনের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ায় ফ্লাইওভারটির ওপরে ও নিচে তীব্র যানজট এখন প্রাত্যহিক ঘটনা।
Leave a Reply